বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৩ পূর্বাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ মশা! রক্তচোষা ক্ষুদ্র এই প্রাণীটিই এখন সবার কপালে ভাঁজ ফেলেছে। অফিস, বাসা কিংবা দোকান কোথায় নেই মশার আগ্রাসন। নিস্তার নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতেও, সেখানেও মশার চলন। গণপরিহনেও মশা করে ভনভন। রাজধানী ঢাকায় এই মৌসুমেও ভয়ংকর চেহারায় ফিরেছে মশা। মশকের বিস্তার রোধও যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সিটি করপোরেশন বছর বছর বাজেট বাড়ালেও মশার যন্ত্রণা কমাতে পারেনি।
মশার এই ডামাডোলে আরো দুঃসংবাদ হলো, গেল ফেব্রুয়ারিতেই রাজধানীতে মশার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় চার গুণ। গবেষণায় মিলেছে এই তথ্য। মশার বাড়াবাড়িতে রাজধানীতে বেড়ে গেছে মশারি, কয়েল আর স্প্রের বিকিকিনিও।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী ৮ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত মশা নিধনে নতুন করে বিশেষ অভিযান চালানো হবে। আর তাতেই নাকি ভালো ফল মিলবে। বাজেট বাড়লেও মশা নিয়ন্ত্রণে না আসার ব্যাপারে কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত যন্ত্রপাতি ও মশার ওষুধ কেনার কাজে বরাদ্দের টাকা ব্যয় হয়। সিটি করপোরেশনের পরিধি ও জনবল বেড়েছে। তাই বাড়ানো হয়েছে বরাদ্দও।
মশার সঙ্গে দিনরাত্রি : রান্নাঘরে দুপুরের খাবার তৈরি করছিলেন রামপুরা এলাকার গৃহিণী সোনিয়া খাতুন। গ্যাসের চুলার পাশেই জ্বলছিল মশার কয়েল। তাঁর ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখা গেল, সেখানেও জ্বলছে ইলেকট্রিক মশার ম্যাট। সোনিয়া বললেন, ‘খেতে গেলে ভাতের আগে মুখে মশা ঢুকে যায়। সব রুমে কয়েল জ্বালিয়ে রেখেছি। তা-ও উড়ছে মশা।
একই সুরে কথা বললেন রামপুরার আরেক বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বাসায় দেড় বছরের শিশু। সারা দিন ওকে তো আর মশারির মধ্যে রাখা যায় না। কিন্তু কী করব, এত মশার উৎপাত। মাঝেমধ্যে সিটি করপোরেশন এসে ওষুধ ছিটায়। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় বলে মনে হয় না।
শ্যামলীর বনানী রহমান বলেন, ‘ছাদে যাওয়া বাদ দিয়েছি মশার ভয়ে। বাসার ভেতরে এরোসল দিলে মনে হয় ওষুধের ঝাঁজে আমরাই মরে যাব; কিন্তু মরছে না মশা।
ফেব্রুয়ারিতেই মশার ঘনত্ব বেড়েছে চার গুণ : গবেষণা বলছে, গেল ১৪ মাসের মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতেই রাজধানীতে মশার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় চার গুণ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার এই তথ্য জানান। প্রতি মাসে রাজধানীর ছয়টি এলাকাকে নমুনা ধরে সেখানকার ঘনত্ব থেকে ডিজিজ প্রেডিকশন এবং মসকুইটো প্রেডিকশন করেন এই গবেষক। নমুনা এলাকাগুলো হলো—যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া, শাঁখারীবাজার, মোহাম্মদপুর-শ্যামলী, পরীবাগ-সেন্ট্রাল রোড-শাহবাগ, উত্তরা এবং খিলগাঁও-বাসাবো। ডিপার নামের একটি ডিভাইস দিয়ে মাপা হয় মশার ঘনত্ব। এ ক্ষেত্রে ডিপারটি একবার পানিতে ডোবানোর পর তুলে এনে সেখানে কতগুলো মশা পাওয়া গেল তা গণনা করা হয়। এভাবে প্রতিটি নমুনা এলাকা থেকে ২০০টি নমুনা সংগ্রহ করে সেটির গড় করে ওই এলাকার মশার ঘনত্ব বের করেন কবিরুল বাশার।
তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আমরা এই গবেষণা শুরু করি। বছরের অন্য সময়ে আমরা এখানে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি মশা পাই, যেটি এখন গড়ে ৫০টিরও ওপরে। অর্থাৎ অন্যান্য মাসের চেয়ে ফেব্রুয়ারিতে মশার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় চার গুণ। জানুয়ারিতে এই ঘনত্ব ছিল দ্বিগুণ। এখনই র্যাপিড ক্রাশ প্রগ্রাম না করলে মার্চে এই ঘনত্ব ৫০ থেকে বেড়ে ৬০-এ চলে যেতে পারে।
ড. কবিরুল বাশার বলেন, এখন যে মশাগুলো দেখা যায় তার ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই কিউলেক্স মশা, এডিস নয়। কিউলেক্স মশার মাধ্যমে ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ হয়। তবে এটি উত্তরবঙ্গের কিছু জেলায়ই হয়। ঢাকায় তেমন দেখা যায় না। কারণ রোগ ছড়ানোর জন্য এই মশার শরীরে এক ধরনের কৃমির দরকার পড়ে। নিয়মিত কৃমির ওষুধ খাওয়ার জন্য ঢাকার মানুষের দেহে এই কৃমি থাকলেও তা রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। কিউলেক্স মশা দিনে লুকিয়ে থাকে। সন্ধ্যার পর থেকে তারা অ্যাক্টিভ হয়ে সারা রাত থাকে। এই মশাটি সারা বছরই থাকে, তবে শীতে বেড়ে যায়। আর এডিস মশা বাড়ে বর্ষায়। অন্যদিকে বৃষ্টি যত বাড়ে, কিউলেক্স মশা তত কমে।
কিউলেক্স মশার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি আসলে নর্দমা ও ডোবার পচা পানিতে হয়। নর্দমা ও ডোবা পরিষ্কার এবং মশা নিয়ন্ত্রণের পুরো দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের নর্দমা ও ডোবার পানি চলমান করে দিতে হবে। একই সঙ্গে সেখানে লার্ভিসাইড, অ্যাডাল্টিসাইট কিংবা গাপ্পি ফিশ (মশার লার্ভা খায়) ছাড়তে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যদি ওষুধ ছিটানোর সময় এবং পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়, তাহলে যে কীটনাশক আছে সেটি দিয়েই মশা মরার কথা। প্রতিটি কীটনাশকেরই একটি কার্যকাল রয়েছে। কতটুকু পানিতে কতটুকু কীটনাশক দিতে হবে, সেটিরও একটি পরিমাণ আছে। একবার সেখানে কীটনাশক দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সাত দিনের মধ্যেই সেখানে ওষুধ দিতে হবে। পরিমাণ এবং ইন্টারভাল (কত সময়ের ব্যবধানে কীটনাশক দেওয়া হবে) যদি সঠিকভাবে মানা হয়, তাহলে সেটি কাজ করবেই।
মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ : মশক নিধনে ২০২০-২১ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বাজেট রাখা হয়েছে ৭৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৪৯ কোটি ৩০ লাখ। তারও আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই কার্যক্রমের জন্য ডিএসসিসির বাজেট ছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
মশা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ছুটির দিন ছাড়া অন্য দিনগুলোতে সকালে চার ঘণ্টা লার্ভিসাইডিং করা হয়। পরে দুপুর আড়াইটা থেকে আবার চার ঘণ্টার মতো অ্যাডাল্টিসাইডিং করা হয়। আমরা এত দিন এডিস মশা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম এবং অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে আমরা সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি, যে কারণে ডেঙ্গুতে কোনো প্রাণহানি হয়নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ডিসেম্বরের শেষ এবং জানুয়ারির দিকে কিউলেক্স মশার প্রাদুর্ভাব ঘটে। মূলত জলাশয়গুলো থেকে কিউলেক্স মশার প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ এলাকায় ছোট ছোট জলাশয় বেশি। সে কারণেই কিউলেক্স মশার উৎপত্তিও বেশি। তার পরও অন্যান্য বছরের চেয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমরা যে কীটনাশক ব্যবহার করি, বেশিদিন ব্যবহার করলে সেটি মশার সহনশীল হয়ে যায়। এ জন্য আমরা কীটনাশক পরিবর্তনও করেছি। এরই মধ্যে আমরা নতুন কীটনাশক আমদানি করেছি। আগামী দুই সপ্তাহ পর থেকেই নতুন কীটনাশক প্রয়োগ করা হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে গত ৪০ বছরের ইতিহাসের মধ্যে কিউলেক্স মশাটা অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমি আশাবাদী, ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য পরিষ্কারের যে ব্যবস্থা নিয়েছি, এর কারণেও আগামী দিনে মশা আরো অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। শনিবার ছুটির দিন হওয়ার পরও সারা দিন আমরা কাজ করি। এই সপ্তাহ আমাদের নরমাল রুটিন কার্যক্রম ও প্রস্তুতি চলবে। আগামী ৮ থেকে ১৬ মার্চ আমরা একটি বিশেষ অভিযান চালাব। আশা করছি, একটি ভালো ফল আমরা পাব।
ওষুধ মশার জন্য সহনশীল হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি লট ইস্যু করার আগে দুই দিন ধরে আমরা পরীক্ষা করি। আমাদের নিজস্ব পরীক্ষার পাশাপাশি এটি আমরা আইইডিসিআর, কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণাগার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের গবেষণাগারে পরীক্ষা করি। সেখানে আমরা দেখেছি, ওষুধটি শতভাগ কার্যকর।’ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওষুধ দেওয়া হয় কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কখন কোন এলাকায় ওষুধ দেওয়া হবে, সেটি আমাদের রুটিন করা আছে। ওষুধটি আমরা শিডিউল অনুযায়ী দিই। তবে আমার মনে হয়, নাগরিকদের কিছু দায়িত্ব আছে। আমরা ড্রেনগুলোকে পরিষ্কার করছি, সেখানে লার্ভিসাইড দিচ্ছি; কিন্তু সেখানে আবারও তারা ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। এটির বিষয়ে নগরবাসীর আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত।
বেড়েছে মশারি, কয়েল ও স্প্রের বিক্রি : এদিকে মশা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে লাফিয়ে বাড়ছে মশারি, কয়েল ও মশার স্প্রের বিক্রি। গুলশানের রহমান ফার্মেসির বিক্রেতা শামসু বলেন, ‘মশার স্প্রের বিক্রি বাড়ছে। কারণ মশা বাড়ছে। কয়েক দিন ধরে দোকানের মধ্যেও আমাদের কয়েল জ্বালাতে হচ্ছে। তবে বিক্রি বাড়লেও কয়েল বা মশার স্প্রে কোনোটিরই দাম বাড়েনি।’ যদিও মশারির দাম আগের চেয়ে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন অনেক ক্রেতা।
নুজহাত রশিদ নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ছয় বছর ধরে মেসে থাকি। কোনো দিন মশারি কিনতে হয়নি; কিন্তু গতকাল বাধ্য হয়েই মশারি কিনলাম। মশার যন্ত্রণায় আর থাকতে পারছি না।
মশা বাড়ার কারণেই যে মশারির বিক্রি বেড়েছে সে কথা অবশ্য বিক্রেতারাও স্বীকার করলেন। হামিদ মিয়া নামের মিরপুরের এক ভ্রাম্যমাণ মশারি বিক্রেতা বলেন, ‘মশা বাড়ছে আর আমার কপাল খুলছে। তয় আমি নিজেও রাইতের বেলা মশার জ্বালায় অস্থির হইয়া যাই। ভাতও খাই মশারির মধ্যে বইয়া। মিরপুর, কল্যাণপুর, রামপুরা, মালিবাগ, নতুন বাজার, মৌচাক এলাকার বেশ কয়েকটি মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে সাধারণ মশারির সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিক মশারিরও রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।
Leave a Reply